উপকারকারী এবং দানগ্রাহী

Neaz
0

বাংলা ভাষায় একটি প্রবাদ রয়েছে যা অনেকেরই পরিচিত - "উপকারকারীকে বাঘে খায়"। এই প্রবাদটি মানুষের মধ্যে একটি সাধারণ ধারণাকে প্রতিফলিত করে যে, আপনি যদি কারও উপকার করেন, তবে সেই ব্যক্তি হয়তো আপনার উপকারের কথা দীর্ঘদিন মনে রাখবে না। এই ধারণাটি এতটাই প্রচলিত যে অনেকে হতাশার সঙ্গে বলে থাকেন, "পৃথিবীর নিষ্ঠুরতম সত্য হলো আপনার উপকারের কথা মানুষ বেশিদিন মনে রাখবে না।"


beneficiary vs benefactor


এই দৃষ্টিভঙ্গি থেকে দেখলে, মনে হতে পারে যে জীবনের একটি নিদারুণ বাস্তবতা হল, আপনি কার কাছে কতদিন প্রাধান্য পাবেন, তা নির্ভর করে আপনি কার জন্য কতদিন কিছু করতে পারেন তার উপর। এই ধারণাটি যদিও অনেকের কাছে সত্য বলে মনে হয়, কিন্তু এর মূলে একটি গুরুত্বপূর্ণ সমস্যা রয়েছে - তা হল উপকারের সংজ্ঞা নিয়ে।

আসলে, যদি আপনি কারও জন্য ভালো কিছু করেন এবং প্রত্যাশা করেন যে সেই ব্যক্তি আপনার ভালো কাজ মনে রাখবে বা আপনার কোনো উপকার করবে, তাহলে সেটা আর উপকার থাকে না, বরং তা হয়ে যায় একধরনের বিনিময়। উপকারের প্রকৃত সংজ্ঞা হল এমন কিছু করা যার পিছনে কোনো প্রত্যাশা থাকে না।

কিন্তু এখানে একটি প্রশ্ন জাগে: আমরা কি সত্যিই কোনো প্রত্যাশা ছাড়া উপকার করতে পারি? একজন মানুষ হিসেবে এটা কি সম্ভব? কারণ, আমরা যা-ই করি, তার পিছনে কোনো না কোনো উদ্দেশ্য বা আশা থাকেই।

এই জটিল পরিস্থিতির একটি সুন্দর সমাধান দিয়েছে ইসলাম ধর্ম। ইসলামের দৃষ্টিকোণ অনুযায়ী, আপনি অন্যের প্রতি অনুগ্রহ করবেন এবং বিনিময়ে কিছু আশাও করতে পারেন। কিন্তু সেই প্রত্যাশা আপনি রাখবেন না যার প্রতি আপনি অনুগ্রহ করেছেন তার কাছ থেকে, বরং আপনি সেই প্রত্যাশা রাখবেন কেবলমাত্র আল্লাহর কাছে।

ইসলামী দৃষ্টিভঙ্গি

প্রথমত, এই দৃষ্টিভঙ্গি আপনাকে একটি বৃহত্তর পরিসরে উপকার করতে উৎসাহিত করে। আপনি শুধুমাত্র সেই ব্যক্তিদের প্রতি অনুগ্রহ করার ইচ্ছা পোষণ করবেন না যারা আপনাকে প্রত্যক্ষভাবে কিছু ফিরিয়ে দিতে পারে। বরং, আপনি আপনার স্বার্থ নির্বিশেষে যে কারও প্রতি উপকার করতে পারেন। কারণ আপনি জানেন যে আপনার ভালো কাজের রেকর্ড রাখার জন্য আল্লাহ সর্বদা উপস্থিত আছেন এবং তিনিই আপনার ভালো কাজের যথাযথ মূল্যায়ন ও প্রতিদান করবেন।

দ্বিতীয়ত, এই দৃষ্টিভঙ্গি উপকার গ্রহণকারীর উপর থেকে একটি মানসিক বোঝা লাঘব করে। যে ব্যক্তি আপনার অনুগ্রহ গ্রহণ করছে, তার কাছে আপনার অনুগ্রহের প্রতিদান স্বরূপ কোনো বোঝা বহন করতে হবে না। সে জানে যে কৃতজ্ঞতা প্রকাশ ছাড়া তার আর কিছুই ফেরত দিতে হবে না। এটি উপকার গ্রহণকারীকে স্বাচ্ছন্দ্যে উপকার গ্রহণ করতে সাহায্য করে।

তৃতীয়ত, এই দৃষ্টিভঙ্গি আপনার নিজের জন্যও সুবিধাজনক। যখন আপনি কোনো সমস্যায় পড়বেন এবং আপনার কিছু সাহায্যের প্রয়োজন হবে, তখন আপনাকে কেবল তাদের কাছেই সাহায্য চাইতে হবে না যাদের আপনি আগে সাহায্য করেছিলেন। আপনি আল্লাহর কাছে সমাধান চাইতে পারেন এবং বিশ্বাস রাখতে পারেন যে তিনি আপনার সমস্যার সমাধান করবেন।

অবশ্যই, এর অর্থ এই নয় যে আল্লাহ আপনার সমস্যা সমাধানের জন্য কোনো ফেরেশতা পাঠাবেন। বরং, আপনাকে আপনার সমস্যা সম্পর্কে অন্য লোকেদের জানাতে হবে। কিন্তু মূল বিষয় হল, আপনি যাদের কাছ থেকে সাহায্য পেতে পারেন তার পরিসর এখন অনেক বেশি বিস্তৃত।

এখন একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন উঠতে পারে: ইসলাম কি তাহলে উপকারকারীর প্রতি অকৃতজ্ঞ হওয়ার পরামর্শ দেয়? উত্তর হল, কখনোই না। ইসলাম একদিকে যেমন আপনাকে নিঃস্বার্থভাবে অন্যের উপকার করতে উৎসাহিত করে, তেমনি অন্যদিকে সেই ব্যক্তিকেও আপনার প্রতি কৃতজ্ঞ হওয়ার নির্দেশ দেয় যে আপনার অনুগ্রহ পেয়েছে।

হাদিস শরীফে বর্ণিত আছে, রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, 

"যে ব্যক্তি মানুষের প্রতি কৃতজ্ঞ নয়, সে আল্লাহর প্রতিও কৃতজ্ঞ নয়।" (তিরমিযি) 

এই হাদিস থেকে স্পষ্ট যে ইসলাম উপকারকারীর প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশকে অত্যন্ত গুরুত্ব দেয়।

তবে, কৃতজ্ঞতা প্রকাশের অর্থ এই নয় যে আপনাকে অবশ্যই উপকারকারীর প্রতি কোনো প্রতিদান দিতে হবে। কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করা যায় একটি সরল "ধন্যবাদ" বলে, একটি দোয়া করে, বা উপকারকারীর জন্য ভালো কিছু করার চেষ্টা করে।

এই ইসলামী দৃষ্টিভঙ্গি উপকারকারী এবং উপকার গ্রহণকারী উভয়ের জন্যই একটি সুন্দর সমতা তৈরি করে। উপকারকারী নিঃস্বার্থভাবে উপকার করতে পারেন, কারণ তিনি জানেন যে তার প্রতিদান আল্লাহর কাছ থেকে আসবে। অন্যদিকে, উপকার গ্রহণকারী কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করতে পারেন, কিন্তু তাকে কোনো বাধ্যবাধকতার বোঝা বহন করতে হয় না।

সর্বোপরি, এই দৃষ্টিভঙ্গি সমাজে একটি ইতিবাচক চক্র তৈরি করে। যখন মানুষ নিঃস্বার্থভাবে উপকার করে এবং সেই উপকারের জন্য কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করা হয়, তখন তা সমাজে সহযোগিতা ও সম্প্রীতির একটি পরিবেশ তৈরি করে। এটি শুধু ব্যক্তিগত সম্পর্ককেই নয়, সামগ্রিক সামাজিক বন্ধনকেও শক্তিশালী করে।

তাই, "উপকারকারীকে বাঘে খায়" - এই প্রবাদটি যদিও সমাজে প্রচলিত, কিন্তু ইসলামী দৃষ্টিভঙ্গি আমাদেরকে এর চেয়ে অনেক বেশি ইতিবাচক ও গঠনমূলক একটি পথ দেখায়। এই পথ অনুসরণ করে আমরা একটি অধিক সহানুভূতিশীল, কৃতজ্ঞ ও সুখী সমাজ গড়ে তুলতে পারি।

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0মন্তব্যসমূহ

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন (0)

#buttons=(Ok, Go it!) #days=(20)

Our website uses cookies to enhance your experience. Check Now
Ok, Go it!