সৌন্দর্য কে কিভাবে সংজ্ঞায়িত করা যায়? সৌন্দর্য কেন বয়স, পরিবেশ মানুষের মানসিক অবস্থা ভেদে ভিন্ন? তা নিয়ে মানুষের কৌতূহলের অন্ত নেই। এ নিয়ে দার্শনিকগণের মতামতের ও কমতি নেই। বিভিন্ন সময় বিভিন্ন ভাবে সৌন্দর্যের পরিভাষা খোঁজার চেষ্টা করা হয়েছে। গণিত শাস্ত্রের ভাষাকে ব্যবহার করে সৌন্দর্যকে সংজ্ঞায়িত করার প্রচেষ্টা ও নিতান্ত কম হয়নি। মার্টিন ওহমের আবিষ্কৃত Golden Ratioর দ্বারা সৌন্দর্যকে সংজ্ঞায়িত করার সর্বোচ্চ চেষ্টা করেছেন দা ভিঞ্চি। তবে এই যুগে এসেও কোন ভাবে বলা যায় না যে, সৌন্দর্যকে জ্যামিতি কিংবা গাণিতিক নিয়মের মধ্যে ফেলে পুরোপুরি ব্যাখ্যা করা সম্ভব। বরং সৌন্দর্যের উপলব্ধি হলো মানুষের যৌক্তিকতা সত্তা এবং অবচেতন সত্তার একটি মিশ্র হৃদয়ঙ্গমকারী অনুভূতি, যা মানুষকে সেই সৌন্দর্যের সাথে যুক্ত করে। যখন আমরা কোন স্থানে কিছু পূর্বনির্ধারিত জ্ঞান বা চিন্তা নিয়ে প্রবেশ করি, তখন আমরা আমাদের কল্পনাকে সেই পূর্বনির্ধারিত মানের সাথে সম্পর্কিত করার চেষ্টা করি। এই পূর্ব নির্ধারিত মান গুলোকে প্রতিষ্ঠিত করার জন্য প্রভাবক কারণগুলি হতে পারে ওই স্থানের নাম, স্থানের পিছনে থাকা গল্প, বা কিছু বিজ্ঞাপন যা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম কিংবা লোকোমুখে আমরা শুনে থাকি। এই সকল মানগুলো আমাদের সৌন্দর্যের উপলব্ধিকে আবেগ তাড়িতভাবে প্রভাবিত করতে পারে যার দরুন ওই মান গুলোই আমাদের অবচেতন মনে সৌন্দর্যের মাপকাঠি হিসেবে প্রতিমান হয় এবং অন্যান্য নান্দনিক কারণগুলো হয়তোবা আমরা সচেতন ভাবেই উপেক্ষা করে থাকি। এমনই একটি উপলব্ধি আপনি পেতে পারেন যখন কোরিয়ার ডেগু শহরে অবস্থিত MILLIM ক্যাফেকে পরিদর্শন করবেন।
কোরিয়ান ভাষাতে MILLIM শব্দের অর্থ জঙ্গল। ক্যাফের এই নামই একটি অনুভূতি জায়গায় যে, আপনি জায়গাটি প্রদর্শনের সময় জঙ্গলের একটি আবহ উপলব্ধি করবেন। ক্যাফের প্রবেশদ্বারেই ক্যাফেটির গঠন এবং এই স্থাপনা তৈরির পেছনের প্রত্যয় খুব ভালোভাবে বর্ণনা করা হয়েছে। সুতরাং ক্যাফেতে প্রবেশের পূর্বেই এই স্থান সম্পর্কে আমাদের প্রত্যাশা এবং চিন্তাগুলো স্থপতি দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হওয়া শুরু করে এবং নান্দনিক চোখ জুড়ানো পরিবেশের পরিবর্তে আপনার প্রত্যাশাগুলো প্রতিস্থাপিত হয় একটি অন্ধকার, ভয়ংকর এবং স্তব্ধ পরিবেশ উপলব্ধির প্রতি। MILLIM সম্মানসূচক স্থাপত্য পুরষ্কার প্রাপ্ত একটি স্থাপনা যা নির্মাণ করা হয়েছে আপ্সান পর্বতের পাদদেশে আল্পাইন উপত্যকাতে। MILLIM ক্যাফেটি বনভূমিময় পাহাড়ের থিম নিয়ে নির্মাণ করা হয়েছে। এটি একটি সবুজ বনের ল্যান্ডস্কেপ এবং অভ্যন্তরীণ স্থানটি গভীরভাবে লুকানো অনাবিষ্কৃত ল্যান্ডস্কেপ এবং বিলুপ্ত প্রাণীর স্বরূপ চিত্রিত করে জঙ্গলের দ্বৈত প্রকৃতির অনুলিপন করে। উপরের তলাটি প্রকৃতিতে বসবাসকারী অনিয়মিত সরীসৃপ প্রাণীদের জন্য ডিজাইন করা হয়েছে। এটি এমন একটি বাস্তুতন্ত্র তৈরির একটি পদ্ধতি যেখানে মানুষ, প্রকৃতি এবং প্রাণীরা একটি উল্লম্ব জায়গায় সুরেলাভাবে সহাবস্থান করতে পারে। বিল্ডিংয়ের বাইরের অংশটি ক্রমবর্ধমান গাছের মতো যা ৪র্থ তলার কাঠামোর সাথে সারিবদ্ধ। বাইরের দেয়ালটি কর্ক স্প্রে নামক একটি প্রাকৃতিক এবং পরিবেশ-বান্ধব উপাদান দিয়ে প্রলেপিত, যা প্রকৃতির বিরল প্রাণীদের টেক্সচারকে অনুকরণ করে। ভবনটির তির্যক আকৃতিটি উত্তর থেকে সরাসরি সূর্যালোক কেটে দেওয়ার জন্য ডিজাইন করা হয়েছে।
MILLIM ক্যাফেটি আরামদায়ক ছায়া এবং রহস্যময় কুয়াশা ঘেরা একটি বনে থাকার অনুভূতি জাগানোর জন্য ডিজাইন করা হয়েছে। অভ্যন্তর স্থানগুলো উচ্চ , খোলা, এবং প্রশস্ত বনের একটি ধারনা দেয়। গাঢ় কংক্রিটের স্ল্যাব যা দেয়াল এবং ছাদে উন্মুক্ত করা হয়েছে তা প্রাকৃতিক রুক্ষতার স্পর্শ যোগ করে। দ্বিতীয় তলায় নিচু জানালা রয়েছে যা বেশিরভাগ আলোকে অবরুদ্ধ করে, এবং একটি আবছা-অন্ধকারময় পরিবেশ তৈরি করে। তৃতীয় তলটি উজ্জ্বল এবং আরও বায়বীয়, কারণ এটি একটি বহিরঙ্গন টেরেসের সাথে সংযুক্ত এবং এই তলা পাথরের উপকরণ এবং কৃত্রিম গাছের সমারহে সজ্জিত। চতুর্থ তলা একটি গ্যালারি যা বিভিন্ন সরীসৃপ প্রদর্শনের জন্য উন্মুক্ত এবং এটি সব থেকে উজ্জ্বল তলা। দ্বিতীয় থেকে চতুর্থ তলায় উজ্জ্বলতা ধীরে ধীরে বৃদ্ধি বনের উল্লম্ব স্তরগুলিকে প্রতিফলিত করে এবং এটি একটি সুচিন্তিত অভিসন্ধান।
সামগ্রিকভাবে, দর্শনার্থীরা স্থানটিতে একটি বনের অভিজ্ঞতা খুঁজে বের করার দিকে মনোনিবেশ করতে বাধ্য হবেন, যা স্থপতির একটি নিরঙ্কুশ মনস্তাতিক খেলা। যদিও লোকেরা এটিকে প্রসন্ন দৃষ্টিভঙ্গির সাথে আরাম করার জন্য একটি নান্দনিক জায়গা হিসাবে বিবেচনা করতে পারবে না তবে পরিবেশ থেকে প্রাপ্ত তাদের অভিজ্ঞতাগুলি নিঃসন্দেহে অনন্য হবে।