একটি গল্প দিয়ে শুরু করি। যেটি হয়তো ইসরাইল-ফিলিস্তিনের মধ্যে ঘটতে থাকা বর্তমান যুদ্ধের প্রেক্ষাপট, জটিলতা এবং ভবিষ্যৎ সম্ভাবনা সম্পর্কে কিছু পরিজ্ঞান আপনাদের সামনে উপস্থিত করবে। গল্পটি তাওরাতের স্যামুয়েল অধ্যায় ১৭ তে বর্ণনা করা আছ। তখন ইসরাইলীরা (বনি ইসরাঈল) মিশরে ফারাওদের দাসত্ব থেকে বের হয়ে নিজেদের প্রতিশ্রুত ভূমির খোঁজে সিনাই পর্বতে ঘুরেফিচ্ছিল।
অবশেষে তারা ফিলিস্তিনে পৌঁছায় এবং সেখানে বসতি গড়া শুরু করে। যেহেতু ফিলিস্তিনিরা ওই ভূমিতে প্রথমে বসবাস করছিল এবং তারাই ওই জমির মালিক ছিল এবং ইসরাইলীরা ফিলিস্তিনিদের জমিতে বসতবাড়ি তৈরি করছিল তাই একটি লড়াই শুরু। এ লড়াইয়ে ফিলিস্তিনিরা প্রথম বিজয় লাভ করে। তা সত্ত্বেও ফিলিস্তিনিরা ইসরাইলেদের ফিলিস্তিনে থাকার অনুমতি দেয় কিন্তু ইজরাইলিদের ওপর কোন প্রকার হাতিয়ার নিজেদের সাথে না রাখার সিমাবদ্ধতা অর্পণ করে। তাই ইসরাইলিরা একমাত্র হাতিয়ার হিসেবে যা ব্যবহার করতো তা হচ্ছে একটি দড়ির মত বস্তু যাতে পাথর বেঁধে কোন নিশানায় তারা ছুড়ে মারতো যাকে ইংরেজিতে Sling বলা হয় (যা এখনকার ফিলিস্তিনি যুবকদের হাতেও আপনারা দেখতে পারেন)। সেই সময় ফিলিস্তিনে জালুত নামে একজন লম্বা-চওড়া, অত্যন্ত শক্তিশালী যোদ্ধা ছিল । একদিন জালুত নিজের অহংকার বসে পুরো ইসরাইলিদের চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দিল। “কেউ কি আছে ইসরাইলিদের মধ্যে যে আমার সঙ্গে লড়াই করার সাহস রাখে?” কোন ইসরাইলেরই তার সাথে লড়াই সাহস করেনি। কিন্তু একজন নওজোয়ান বালক ডেভিড সাহস দেখালো। এই যুবকটি ঐ যোদ্ধার থেকে অনেক দুর্বল এবং ছোট ছিল কিন্তু সাহস এবং আল্লাহর প্রতি বিশ্বাস ছিল অপরিসীম। সে Sling-এ পাথর বেঁধে জালুতের দুই চোখের এর মাঝে নিশানা করে ছুড়ে মারে। পাথরের আঘাতে জালুত ভূপতিত হয় এবং ডেবিট তার তরবারি দিয়ে জালুতের মস্তক আলাদা করে হাতে উঠিয়ে নেয়। এই চ্যালেঞ্জের লড়াইয়ে ইসরাইলিরা জিতে যায় এরপর এই সাধারণ যুবকই ইসরাইলিদের বাদশাহ হয়। পরবর্তীতে আশেপাশের পুরো অঞ্চলে সে তার শাসন কায়েম করে। ডেভিড এর পুত্রই সলোমন যিনি হাইকাল সলোমন প্রতিষ্ঠা করেন যা পুনঃ প্রতিষ্ঠা করার জন্যই ইসরাইলীরা আজও লড়াই করছে। (ইসলামে এই দুজনকে আমরা দাউদ (عَلَيْهِ ٱلسَّلَامُ) এবং সোলাইমান (عَلَيْهِ ٱلسَّلَامُ) নামে চিনি যাদের কাহিনী আল-কুরআনের বিভিন্ন জায়গায় বর্ণনা করা হয়েছে।) আপনি আজও যদি এমন এলাকায় যান যেখানে ইহুদি লোকের সংখ্যা বেশি সেখানে এমন একটি ছবি দেখতে পাবেন যেখানে সাধারন বালক একটি অতিকায় মস্তক হাতে অথবা পায়ের নিচে ধরে রেখেছে। একে ডেভিদ গলিয়াথ (Devid Goliath) বলা হয়।
ইসরাইলিরা আজও এই ছবিকে ফিলিস্তিনের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করার অনুপ্রেরণা হিসেবে ব্যবহার করে। কিন্তু ফিলিস্তিনিদের ভাব আদর্শ তো অনেক বদলে গিয়েছে। এর জন্যই দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে ইহুদিদের ওপর দুর্দশা দেখে ফিলিস্তিনিরা তাদের নিজেদের ভূমিতে অভিবাসী ইহুদিদের আশ্রয় দেয়। কিন্তু পুরনো সেই লড়াই এখনো বহাল আছে। মাঝে মাঝে মনে হয় ইসরাইল এবং ফিলিস্তিনের ডানপন্থীরা একে অপরকে মানুষ হিসেবেই মনে করে না। কেননা যে মানুষগুলোর ভালোর জন্য তারা এত বছর ধরে যুদ্ধ করছে সেই ভালো যুদ্ধ ছাড়া পাওয়াই অনেক বেশি সহজ। ইতিহাস ঘাটলেই দেখা যায় অটোম্যান সাম্রাজ্যের সময়েই ইসরাইল এবং ফিলিস্তিনিরা এই ভূমিতেই শান্তির সাথে ৪০০ বছর বসবাস করেছে। আন্দালুসে (স্পেন) মুসলমান শাসনের সময় মুসলমান এবং ইহুদী শান্তির সাথে বসবাসের অনেক নজির পাওয়া যায়।
ইসরাইল-ফিলিস্তিন যুদ্ধের কারণ
তবে কেন এই যুদ্ধ? সত্য বলতে যুদ্ধ এবং সন্ত্রাসবাদ উপনিবেশবাদ স্থাপনের সব থেকে বড় হাতিয়ার। ইংরেজরা ভারত বর্ষকে সভ্য করার নামে উপনিবেশবাদ কায়েম করেছে, আমেরিকানরা সন্ত্রাসবাদের নামে Native আমেরিকানদের ভুমিচুত করেছে এবং শান্তি প্রতিষ্ঠার নামে পুরো দুনিয়ায় হাজার হাজার মিলিটারি স্থাপনা করে রেখেছে। ইসরাইলও ফিলিস্তিনিদের ভূমি ছাড়া করছে নিরাপত্তার দোহায় দিয়ে।
একটি কথা ভাবুন, মাত্র ৪১ কিঃমি লাম্বা এবং ১২ কিঃমিঃ চওড়া একটি ভূমিতে ২২ লক্ষ মানুষ বসবাস করে যাদের তিন দিকে ইসরাইল, সামান্য অংশ মিশর এবং অন্যদিকে সমুদ্র। গত ১৬ বছর ধরে ইসরাইল-গাজার এই সীমান্ত উঁচু দেওয়াল এবং হাজার সিমাবদ্ধতা দিয়ে ঘেরা। এই ২২ লক্ষ মানুষ ইসরাইলের অনুমতি ছাড়া না বাইরে যেতে পারে না ভেতরে আসতে পারে। ইসরাইলের সরকার অনুমতি ছাড়া গাজার লোকেরা কোন পণ্যই ইসরাইল-গাজা সীমান্ত দিয়ে আমদানি করতে পারে না। আর কি কি পণ্যের অনুমতি আছে আর কি কি পণ্যের অনুমতি নেই তা জানলে তাজ্জব বনে যেতে হয়। গাজাতে সিমেন্ট, কাঁচের পণ্য, কার্বন ফাইবার, ড্রিলং মেশিন, পানি তোলার পাম্প, গ্যাস, তেল, কেমিক্যাল যা দিয়ে কোন প্রকার হাতিয়ার বানানো যায় তা আমদানি করা নিষিদ্ধ। এমনকি পানি পরিষ্কার করার কেমিক্যাল, আদা, টমেটো ও আমদানি অবৈধ। এবং এই লিস্টে প্রতিনিয়ত নতুন পণ্য সংযোজন করা হয়। এক ইসরাইল মিলিটারি অফিসারের মতে গাজা হচ্ছে দুনিয়ার সবথেকে বড় Open Air জেল। তথা কথিত সভ্য দুনিয়া জিজ্ঞাসা করে হামাস কেন ইসরাইলের উপর আক্রমন করলো? কিন্তু আমার তো অবাক লাগে এই ভেবে যে ১৬ বছর ধরে বন্ধি দশায় থেকে আরও আগে আরও বড় আক্রমন কেন আগে হলো না! হা হামাসের এই আক্রমণে নিরস্ত্র মানুষের হত্যাকে কোন ভাবেই সমর্থন করা যায় না। তবে ১৯৪৮ সাল থেকে ফিলিস্তিনিরা প্রায় প্রতিদিনই ইসরাইল কত্রিক এমন আক্রমনের স্বীকার হচ্ছে। আরও মানি হামাসের এই আক্রমণ আত্মহত্যা ছাড়া আর কিছু না। কিন্তু আত্মহত্যার প্রবনতা না থাকলে স্বাধীন হওয়া যায় না।