মা(caps)নব সভ্যতার
ইতিহাস জুড়ে জ্ঞান অর্জন ও বিনিময়ের একটি অবিরাম প্রচেষ্টা লক্ষ্য করা যায়, যার প্রতিফলন ঘটেছে বইয়ের বিবর্তনে। মাটির ফলক থেকে শুরু
করে খোল লিখন, মুদ্রিত বই, এবং এখন ডিজিটাল পৃষ্ঠা পর্যন্ত বইয়ের
রূপ বদলেছে কয়েকবার। প্রতিটি রূপান্তরই জ্ঞানকে সংরক্ষণ ও বিস্তৃত করার মানবীয়
তাগিদকেই তুলে ধরে। মানব সভ্যতার ইতিহাস জুড়ে বইয়ের এক বিশেষ গুরুত্ব রয়েছে, জ্ঞানের আধার হিসেবে, গল্পের বাহন হিসেবে, ইতিহাসের দলিল হিসেবে বই আমাদের জীবনে গভীরভাবে জড়িয়ে
রয়েছে।
(toc) #title=(বিষয়বস্তুর সারণী)

বইয়ের ইতিহাস জুড়ে জ্ঞানের দীপশিখা
যে সময় মানুষ লিখতে শিখল, সেই সময় থেকেই
বইয়ের ইতিহাস শুরু। প্রাচীন সভ্যতায় কাদামাটির ফলকে ক্যালামাস (কলম) দিয়ে লেখা হতো
জ্ঞানের কথা। মেসোপটামিয়ায় সুমেরীয়রা এই পদ্ধতি ব্যবহার করতো। এই ফলকগুলো
ছিল খুবই টেকসই; বর্তমান সময়েও কিছু কিছু ফলক পাওয়া যায়,
যা সেই সময়ের জীবনযাত্রা ও চিন্তাধারার অমূল্য সাক্ষী।
পরে মিশরীয়রা নীল নদীর পাশে জোয়ারে ভেসে আসা এক বিশেষ
ধরণের নলখাগড়া জাতীয় উদ্ভিদ
থেকে তৈরি করতো পেপিরাস। পেপিরাসের উপর কালি দিয়ে লেখা হতো। পেপিরাসের
পাতাগুলোকে পাশাপাশি জোড়া লাগিয়ে দীর্ঘ খাতা তৈরি করা হত,
যা আমরা আজকে "স্ক্রোল" (scroll) নামে চিনি। এই
স্ক্রোলগুলোতে মিশরীয়রা হায়ারোগ্লিফিক (hieroglyphic) লিপিতে লিখত।
গ্রিক ও রোমান সভ্যতায়ও পেপিরাসের ব্যাপক ব্যবহার লক্ষ্য করা যায়। পেপিরাসের
স্ক্রোলগুলো ছিল বহনযোগ্য, তবে পেপিরাস টেকসই ছিল না এবং লেখা মুছে যাওয়ার
ঝুঁকি থাকত। তবুও,
এই স্ক্রোলগুলোতে লিখিত মিশরীয় দেবতা ও ফারাওদের কাহিনী আজও আমাদের মুগ্ধ
করে।
খ্রিস্টপূর্ব কয়েকশ বছর আগে চামড়ার উপর লেখার রীতি শুরু
হয়। চামড়া ছিল অনেক বেশি টেকসই, তবে এটি ছিল খুবই মূল্যবান উপকরণ। এই কারণেই
প্রাচীনকালে চামড়ার বই খুব কমই দেখা যেত। মধ্যযুগে ইউরোপে মঠগুলোতে সন্ন্যাসীরা
হাতে বই লিখতেন। এই বইগুলো
ছিল আলংকৃত চামড়ার পাতায় লেখা এবং খুবই মূল্যবান।
পঞ্চম শতাব্দীতে চীনা সভ্যতায় কাগজ আবিষ্কৃত হয়, যা বইয়ের ইতিহাসে এক বিরাট বিপ্লব ঘটায়। কাগজ লেখালেখার জন্য অনেক সুবিধাজনক ছিল - হালকা, টেকসই এবং তুলনামূলক সস্তা। আরবরা সপ্তম শতাব্দীতে কাগজ তৈরির পদ্ধতি শেখে নেয় এবং এটি পুরো ইউরোপ জুড়ে ছড়িয়ে পড়ে।
বইয়ের ইতিহাসে সবচেয়ে বড় বিপ্লব ঘটে ১৫শ শতাব্দীতে। জোহানেস গুটেনবার্গের মুদ্রণযন্ত্রের আবিষ্কার বই
উৎপাদনের প্রক্রিয়াকে সম্পূর্ণরূপে বদলে দেয়। মুদ্রণযন্ত্রের সাহায্যে কাগজে
লেখা অসংখ্য বই তৈরি করা সম্ভব হয়। ফলে, বই আর ধনীদের
বিলাসবহুল সম্পদ হিসেবে না থেকে
সাধারণ মানুষের নাগালের মধ্যে চলে আসে। জ্ঞানের অবাধ প্রবাহ শুরু হয় এবং সাহিত্যের জগৎ
সমৃদ্ধ হয়। মুদ্রণযন্ত্রের কল্যাণেই আজকের প্রকাশনা শিল্পের ভিত্তি স্থাপিত হয়।
মুদ্রিত বইয়ের জনপ্রিয়তা ও ই-বুকের সুবিধা
ডিজিটাল
যুগের আগমনের সাথে সাথে বইয়ের ক্ষেত্রে আরেকটি বিশাল বিপ্লব ঘটে। কম্পিউটার এবং
ইন্টারনেটের উদ্ভাবনের ফলে বই ডিজিটাল পদ্ধতিতে সংরক্ষণ ও বিস্তার লাভ করে।
ডিজিটাল বই বা ই-বুক (e-book)
বহু
সুবিধা নিয়ে আসে। এগুলো সাধারণ বইয়ের চেয়ে অনেক কম জায়গা নেয়, ফলে লাখো লাখো বই একটি ছোট্ট ডিভাইসে ধারণ
করা যায়। এছাড়াও, ই-বুকের ক্ষেত্রে সম্পাদনা, নকশা ও বিতরণ অনেক সহজ। মাত্র কয়েক
ক্লিকেই বিশ্বের যে কোন প্রান্ত থেকে যে কোন সময় ই-বুক কেনা ও পড়া যায়। ই-বুকের আরেকটি
আকর্ষণীয় দিক হলো মাল্টিমিডিয়া সামগ্রী যুক্ত করার সুবিধা। ভিডিও, অডিও এবং মিথষ্ক্রিয় উপাদান
যোগ করে ই-বুকের মাধ্যমে পাঠকদের আরও বেশি করে জ্ঞান অর্জন ও আনন্দ লাভ করানো
যায়।
তবে, মুদ্রিত বইয়ের
জনপ্রিয়তা এখনও ব্যাপক।
ই-বুকের
সুবিধা থাকলেও, অনেক পাঠকই মনে
করেন যে, একটি বইয়ের পাতা
উল্টানোর অনুভূতি, কাগজের গন্ধ, এবং একটি নিজস্ব সংগ্রহ গড়ে তোলার সুখ
ই-বুকে পাওয়া যায় না।
অনেকের
বিশ্বাস, মুদ্রিত বইয়ের
ঐতিহ্য ও মূল্য এখনও অটুট রয়েছে।
ডিজিটাল পৃষ্ঠার ভবিষ্যৎ ও ভার্চুয়াল রিয়েলিটির উদ্ভাবন
শেষ পর্যন্ত,
মুদ্রিত
বই এবং ই-বুকের মধ্যে কোনটি বেছে নেওয়া একজন পাঠকের ব্যক্তিগত পছন্দের উপর নির্ভর করে। কিছু পাঠক
বইয়ের স্পর্শ ও গন্ধ উপভোগ করতে পছন্দ করেন,
আবার
কারো কারো কাছে ই-বুকের সুবিধা ও সহজলতা বেশি গুরুত্বপূর্ণ। উভয় ফরম্যাটেরই নিজস্ব সুবিধা রয়েছে এবং
বিভিন্ন ধরণের পাঠককে আকর্ষণ করে।
এ
কারণেই, মুদ্রিত বই এবং
ই-বুক - দু'টো ই আগামী দিনে
পাশাপাশি টিকে থাকবে বলে বিশ্বাস করা যায়।
এছাড়াও,
বইয়ের
ভবিষ্যৎ আরও কিছু নতুন প্রযুক্তির সাথে জড়িয়ে যেতে পারে। যেমন, অডিওবুক (audiobook)
এর
জনপ্রিয়তা দিন দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে।
ভবিষ্যতে
আরও উন্নত অডিওবুক তৈরি হতে পারে,
যেখানে
কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার (AI)
সাহায্যে
পাঠকের পছন্দের ভাষায় ও কণ্ঠে বই শোনা সম্ভব হবে। এছাড়াও, ভার্চুয়াল রিয়েলিটি (VR)
প্রযুক্তি
ব্যবহার করে বইয়ের গল্পের মধ্যে পাঠককে সরাসরি অবগাহন করানোর মতো উদ্ভাবনীও দেখা
দিতে পারে।
বই
মানুষের সভ্যতার ধারায় জ্ঞানের দীপশিখা। মাটির ফলক থেকে শুরু করে ডিজিটাল পৃষ্ঠা পর্যন্ত, বই আমাদের অতীতকে ধরে রেখেছে, বর্তমানকে সমৃদ্ধ করেছে, এবং ভবিষ্যতের পথ দেখিয়েছে। আজকের দ্বিধান্ত হলো মুদ্রিত বই না কি
ই-বুক - কিন্তু আসলেই কি এটি দ্বিধান্তের বিষয়? বরং, দু'টোই আমাদের জ্ঞানের ক্ষেত্রকে বিস্তৃত
করতে পারে। আসুন, বইয়ের এই অব্যাহত যাত্রায় সঙ্গী হই এবং
জ্ঞানের আলো ছড়িয়ে দেওয়ার প্রতীক হিসেবে বইকে আরও জীবন্ত রাখি।