একটা গল্পই বলি

Neaz
0

 একটা গল্পই বলি। আসলে গল্প বলা স্ট্যাটাস দেওয়া এছাড়া আর কিই বা আমরা করতে পারবো! তিন বিলিয়নের মুসলিম জনসংখ্যা হয়েও একটি ছোট্ট দেশের গণহত্যাকে আমরা রক্ষা করতে পারছি না। মহান আরব নেতারা সর্বোচ্চ যা করতে পেরেছে তা হল ইসরাইলকে দোষারোপ করতে পেরেছে তাও প্রত্যক্ষ ভাবে না পরোক্ষভাবে। সোজা একটি কথা ভেবে দেখুন, ফিলিস্তিনের স্বাধীনতা কি শুধুমাত্র হামাসের আকাঙ্ক্ষা? নাকি ফিলিস্তিনের প্রত্যেকটা মানুষের, এমনকি মুসলিম বিশ্বের প্রত্যেকটা মানুষের আকাঙ্ক্ষা? তবে এই দখলদার ইসরাইলে বাহিনীর কাছ থেকে ফিলিস্তিনের স্বাধীনতা কি এত সহজে আসবে! কত সমাজকর্মী, কত সাংবাদিক, কত দেশি-বিদেশি মানুষ এই স্বাধীনতার প্রত্যাশায় ইসরাইল বাহিনীর হাতে তাদের শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেছে অথচ একটা শোক বার্তা সব ছাড়া আর কিছুই পাওয়া যায়নি, স্বাধীনতার আশা তো অনেক দূরেই থাক। স্বাধীনতার জন্য যুদ্ধ তো করতেই হয়, হোক তা কলমের যুদ্ধ কিংবা অস্ত্রের যুদ্ধ। স্বাধীনতার কাম্যতা যেখানে এত বেশি সেখানে যুদ্ধ করার মানসিকতার এক চরম শূন্যতা দেখা যায়। এগিয়ে আসেনি সভ্য দুনিয়ার মুসলিম সমাজ, ফিলিস্তিনের স্বাধীনতার পক্ষে কেবল লোক দেখানো কথা বলেই বাকি সভ্যতা ক্ষান্ত হয়েছে। এইতো কয়েকদিন আগেই জাতিসংঘের অধিবেশনে সকল মুসলিম নেতাদের সামনেই নেতানিয়াহু ইসরাইলের ভবিষ্যৎ পরিকল্পনার কথা বললেন যেখানে তার প্রস্তাবিত মানচিত্রে ফিলিস্তিনের কোন অস্তিত্ব ছিল না। ৬ অক্টোবর ২০২৩ পর্যন্ত কত ফিলিস্তিনিকে  বিনা দোষে হত্যা করা হয়েছে,  কতজনকে বিনা দোষে জেলে নেয়া হয়েছে,  কত শিশু কত নারী হত্যা হয়েছে বা নির্যাতনের শিকার হয়েছে, অথচ তাদের নাম কেবল খবরের একটি কোনায়-ই  স্থান পেয়েছে। সভ্য দুনিয়ার মানুষ সভ্যতা কে টিকিয়ে রাখতে এতই ব্যস্ত যে এইসব ফিলিস্তিনিদের জীবন সংরক্ষণের থেকে বন্য-প্রাণীর জীবন সংরক্ষণ তাদের কাছে বেশি গুরুত্বপূর্ণ। নামমাত্র কিছু প্রতিবাদ হয়েছে,  কিন্তু হত্যা,  নির্যাতন বন্ধ হয়নি। 


ফিলিস্তিনের স্বাধীনতা



সত্যি বলতে যুদ্ধ তো এখানে হবারই ছিল,  অন্যায় যেখানে এত বেশি প্রতিবাদ তো  সেখানে সবথেকে স্বাভাবিক  বিষয়।  যদি কোন প্রতিষ্ঠিত রাষ্ট্র এই অন্যায়ের প্রতিবাদে সামনে এগিয়ে আসতো তাহলে হয়ত দুর্ভোগ অনেক কম হতো। ইতিহাসে যেখানে অমুসলিমদের প্রতি অন্যায়ের প্রতিবাদ জানাতে মুসলিম শাসকরা যুদ্ধ ঘোষণা করেছে সেখানে আজ মুসলমানদের প্রতি অন্যায় হচ্ছে আর  মুসলিম বিশ্ব  নিরব থেকে সে অন্যায় দেখে যাচ্ছে। প্রতিবাদীর যে শূন্যতা তা বারবার পতিমান হচ্ছে। অসভ্য বলেন আর হারাম বলেন হামাস ঠিক এই শূন্যস্থানটা দখল করেছে। যে স্বাধীনতা ফিলিস্তিনের প্রতিটি মানুষ এবং পৃথিবীর সকল ধর্মপ্রাণ মুসলমানের আকাঙ্ক্ষা সেই স্বাধীনতার পক্ষে অস্ত্র ধরতে পেরেছে। তারা ঠিক সেইখানে আঘাত করতে পেরেছে যেখানে আঘাত করলে পুরো বিশ্বের নজর তারা পেতে পারে।  তারা প্রায় ২০০ জনের উপরে ইসরাইলকে অপহরণ করে নিয়ে এসেছে যাদের  প্রাণের দাম সভ্য দুনিয়ার কাছে সব থেকে বেশি। 


এইতো কয়েকদিন আগেরই কথা, সেই বন্ধীদের মধ্যে চারজনকে উদ্ধার করার জন্য ইসরাইল প্রায় ২৫০ জন  নিরস্ত্র শরণার্থীকে হত্যা করে।  তাদের এই বন্ধী উদ্ধারের  হিরোইক অভিযান  ইসরাইল সহ সকল মিডিয়ায় খুব ফলাও করে প্রচার করা হয়েছে।  তাদের বক্তব্য ২৫০ জন নিরস্ত্র ফিলিস্তিনের প্রাণ গিয়েছে তো কি হয়েছে! তারা চার জন ইসরাইলকে জীবিত উদ্ধার করতে পেরেছে এটাই সবথেকে বড় সাফল্য। কিন্তু আমরা বিষয়টি একটু অন্য দৃষ্টিকোণ থেকে ভেবে দেখি; হামাস ৭ অক্টোবর ২০২৩ তারিখে ইসরাইলের  সীমানায় ঢুকে ১৩০০ জনকে ( ইসরাইলের ভাষ্য মতে) হত্যা করে এবং এই আক্রমণের পেছনে তারা কারণ হিসেবে বলে “যুগের পর যুগ ধরে যেসব ফিলিস্তিনি ইসরাইলের জেলে বিনা দোষে বন্দী আছে তাদেরকে মুক্ত করতে হবে”।  তাহলে কেউ আমাকে ব্যাখ্যা করে বলুন ইসরাইলের ঐ হিরোইক অভিযান এবং হামাসের ৭ অক্টোবরের  অভিযানের মধ্যে ঠিক পার্থক্যটা কোথায় যার জন্য পশ্চিমা  দুনিয়া ইজরাইলকে  নিরঙ্কুশ ভাবে সমর্থন দিয়ে যাচ্ছে আর হামাসকে জঙ্গি সংগঠন হিসেবে অভিহিত করছে!


এখন সেই গল্পটা বলি। হিন্দি নামে একটি  ৬ বছরের মেয়ে তার পরিবারের সাথে দক্ষিন গাঁজার কোন এক অঞ্চলে বসবাস করত। ৮ অক্টোবর থেকে বাজলো এক যুদ্ধের দামামা। বিভিন্ন অঞ্চলে ইসরাইলি সেনা মিসাইল আক্রমণ করছে তার পর সেখানে পদাতিক সেনা সেই অঞ্চল দখল করছে। আর পৃথিবীর চোখে ধুলো দেওয়ার জন্য লিফলেটের মাধ্যমে জানান দেওয়া হচ্ছে যে “এই অঞ্চলে সেনা অভিযান হবে সাধারন নাগরিক গন নিরাপদ আশ্রয়ে সরে পড়ুন।”  যেহেতু জানুয়ারির ২৮ তারিখেই ইসরাইলি ফোর্স লিফলেটের মাধ্যমে  গাঁজারদক্ষিণ অঞ্চলে বসবাসকারী সাধারণ  নাগরিকদেরকে নিজ গৃহ ত্যাকে বাধ্য করছিল তাই হিন্দের চাচা-চাচি এবং তার সকল  চাচাতো ভাই-বোন সহ হিন্দ একটি প্রাইভেট গাড়িতে পশ্চিম গাজার দিকে আশ্রয়ের খোঁজে বের হয়। কিন্তু পৃথিবীতে মনে হয় তাদের কোন নিরাপদ আশ্রয় ছিল না। তাদের বাসা থেকে গাড়িতে করে তারা অল্প দূরত্বেই যেতে পেরেছিল। আনুমানিক একটার সময় হিন্দের চাচাতো বোন ( ১৫ বছর বয়সী লিন) বাশারের ভাই সামির কে ফোন করে। সে ফোন করে জানায় যে তাদের গাড়িকে ইজরাইলি আর্মি ঘিরে ফেলেছে এবং অনবরত তাদের গাড়ির দিকে গুলি ছুড়ছে। লিন এবং হিন্দ ছাড়া তাদের গাড়িতে থাকা প্রত্যেকেই মৃত্যুবরণ করেছে। এরপর সামির বিভিন্ন মাধ্যম ঘুরে প্যালেস্টাইন হেলথ সোসাইটি কে এই তথ্য জানায়। একটি উদ্ধারকারী টিমের টেলিফোন অপারেটর ২ঃ৩০ লিন এবং হিন্দের সাথে যোগাযোগ করতে সমর্থ হয়। লিন ফোনটি ধরে কিন্তু লিনের সাথে টেলিফোন অপারেটরের কথোপকথন এক মিনিটের মধ্যেই শেষ হয়ে যায়। কারণ কি জানতে চান? টেলিফোন অপারেটরের সেই কল রেকর্ড (Still available online) থেকে বোঝা যায় মাত্র দুই মিনিটে তাদের উপর ষাট রাউন্ডের বেশি গুলি ছোড়া হয়েছিল। কে তাদের উপর গুলি করছিল এটা নিয়ে যদি কোন বিভ্রান্তি থাকে তবে স্টিফেন বেকের ( একজন প্রাক্তন FBI কর্মকর্তা)  বিশ্লেষণটি দেখতে পারেন। স্টিফেন বেক বলেন কল রেকর্ড থেকে যে গুলির শব্দ আসছিল তা যেকোন AK প্যাটার্নের রাইফেল (যা সাধারণত হামাস যোদ্ধারা ব্যবহার করে)  তার থেকে বেশি ক্ষমতাসম্পন্ন। এবং এই ধরনের উচ্চ হারে গুলি ছোঁড়ার ক্ষমতাসম্পন্ন রাইফেল সাধারণত ইসরাইল সেনারাই ব্যবহার করে থাকে। সুতরাং এই বিশ্লেষণই প্রমাণ করে যে ইসরাইলের সেনারাই ওই গাড়ির উপর গুলি করছিল। তাছাড়া একটি স্যাটেলাইট ইমেজ সনাক্ত করে যে ঐ দিন দুপুর ২ঃ৩০ এর দিকে হিন্দের গাড়ি থেকে অল্প দূরত্বেই প্রায় চারটি ইসরাইলি  সাজেয়া যান অবস্থান করছিল।


ঘটনা এখানেই শেষ নয়। লিনের সাথে টেলিফোন অপারেটরের কথোপকথন শেষ হওয়া মাত্রই তারা রেড ক্রিসেন্ট সোসাইটির সাথে যোগাযোগ করে এবং উদ্ধারকারী টিম প্রেরণ করতে বলে। রেড ক্রিসেন্ট সোসাইটির ওই ফোনে কল করলে হিন্দ কলটি রিসিভ করে এবং তাদেরকে জানায় যে লিন একটু আগেই গুলিতে মারা গিয়েছে। সে আরো জানায় যে ইজরায়েলই সাঁজোয়া গানগুলো তার গাড়ির দিকে ধাবিত হচ্ছে। 


এই মুহূর্তে কল্পনা করুন একটা ৬ বছরের বাচ্চার মনে কি চলছিল যখন সে একটি গাড়িতে আটকে আছে এবং ওই গাড়িতেই অবস্থান করছে তার পরিবারের সকল মৃত সদস্য গুলো এবং ইসরাইলি সাজোয়াযানগুলো তার গাড়ির দিকেই ধাবিত হচ্ছে এবং মৃত্যুর জন্য ওই ছোট্ট মেয়েটি এক-একটি সেকেন্ড গুনছে যে হয়তো জানেও না মৃত্যু মানে কি।


শেষ পর্যন্ত ৫.৪০ এর দিকে প্যালেস্টাইনি হেলথ অথরিটি ইজরাইলি ডিফেন্স মিনিস্ট্রি থেকে অনুমতি পায় একটি প্যারামেডিক টিম নিয়ে হিন্দের গাড়ির কাছে যাওয়ার জন্য।  সেই প্যারামেটিক টিম কোন রুটে হিন্দের গাড়ির কাছে পৌঁছাবে সেই রুটটিও ইজরাইলি ডিফেন্স মিনিস্ট্রি থেকেই নির্ধারণ করে দেওয়া হয়।  একটি অ্যাম্বুলেন্স নিয়ে প্যারামেডিক টিমটি যখন ঐ নির্ধারিত রাস্তা দিয়েই হিন্দের গাড়ির কাছে পৌঁছাতে চেষ্টা করে তখন রাস্তায় একটি ট্যাঙ্কের গোলা ঐ অ্যাম্বুলেন্সে আঘাত করে এবং প্যারামেডির টিমের সকল সদস্য ঐ স্থানেই মৃত্যু বরণ করেন। তখনো উদ্ধারকারী টিমটি টেলিফোন অপারেটরে হিন্দের সাথে কথা বলে যাচ্ছিল। কিন্তু কিছুক্ষণের মধ্যেই হিন্দের সাথে ওই উদ্ধারকারী টিমটির  সকল যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়।  কিন্তু এই সময় কোন ভালোর জন্যই। 


বিঃদ্রঃ ১২ দিন পর ফেব্রুয়ারি ১২ তারিখে হিন্দ এবং তার পরিবারের লাশ উদ্ধার করা হয় যখন ইসরাইলি সেনা সেখান থেকে সরে যায়।  লাশ উদ্ধারের পর তাদের মরদেহের ভয়াবহ বর্ণনা দেওয়ার মত সাহস কিংবা ভাষা আমার কলমের নেই।


একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0মন্তব্যসমূহ

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন (0)

#buttons=(Ok, Go it!) #days=(20)

Our website uses cookies to enhance your experience. Check Now
Ok, Go it!